ইতিহাসের শিক্ষক ক্লাসে দিল্লির বাদশাহ শেরশাহর কথা বলছিলেন। একসময় তিনি বললেন, শেরশাহ ভারতবর্ষে প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। স্যারের কথা শুনে আমরা সবাই হইহই করে উঠলাম। সমস্বরে জানতে চাইলাম, এটা কীভাবে সম্ভব! তার আগে কি ঘোড়ারা ডাকতে পারত না?
প্রতিবছর ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস কাছাকাছি হলে আমার ছোটবেলার এই স্মৃতি মনে পড়ে যায়। যদিও ওই ক্লাসেই আমরা জেনে গিয়েছি এই ‘ডাক’ কিন্তু ঘোড়ার কণ্ঠের ‘ডাক’ নয়।
প্রদেশের শাসকদের কাছে বাদশাহর হুকুম পৌঁছে দেওয়া কিংবা যুদ্ধের মধ্যে নিজের বা বিরোধী সেনাপতির কাছে বার্তা পাঠানোর ব্যাপারটা অনেক কাল আগে থেকেই প্রচলিত। বেশির ভাগ সময় এগুলো স্বল্প দূরত্বের মধ্যে। কিন্তু যখন কোনো বাদশাহর হুকুমতের এলাকা বেড়ে যেত, তখনই তিনি বিপদে পড়তেন। হেঁটে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বার্তা নেওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। ১৫৪০ সালে মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে যুদ্ধে হারিয়ে আফগান শেরশাহ যখন দিল্লির মসনদে আসীন হলেন, তত দিনে তাঁর সাম্রাজ্য বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্রুত সংবাদ আদান–প্রদানের জন্য বার্তাবাহককে ঘোড়ার সওয়ারি বানানোর কোনো বিকল্প তাঁর ছিল না।
ভারতবর্ষের এ ঘটনার শত বছর পরে, ১৬৬০ সালে বিলাতের রাজা দ্বিতীয় চার্লস প্রথম জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) চালু করেন। হেনরি বিশপ হন প্রথম পোস্টমাস্টার। উদ্দেশ্য একই। বার্তা ও ‘এ ধারকা মাল ও ধার’। হেনরি বিশপ পরে ডাকচিহ্নের (পোস্টমার্ক) উদ্ভাবন করেন। ডাকব্যবস্থা তখন ছিল এখনকার ই-কমার্সের বহুল প্রচলিত ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ সিস্টেম। আপনি জিপিওতে যাবেন, আপনার মালামাল বা চিঠি প্রেরকের নাম–ঠিকানাসহ সেখানে জমা দেবেন, ডাকের কর্মী সেগুলো হিসাব–নিকাশ করে একটা মাশুল (ডাকমাশুল) নির্ধারণ করে প্রাপকের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ওজন ও দূরত্বভেদে এটি ভিন্ন ভিন্ন হতো। প্রাপক মাশুল পরিশোধ করেই সেটি গ্রহণ করবেন। জানা কথা, অনেক প্রাপকই টাকা দিয়ে ডাক গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবেন। এতে ডাক বিভাগের খরচাপাতি বেড়ে গিয়ে ডাকমাশুল বেড়েছে ক্রমাগত। এ সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রায় দেড় শ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মধ্যে ১৭৯৩ সালে ব্রিটেন ডাককর্মীদের জন্য খাকি রঙের পোশাক প্রবর্তন করে।
আর এসব করতে করতে এসে পড়ে ১৮৩০-এর দশক। দশকজুড়ে নানা প্রাযুক্তিক উন্মাদনার মধ্যে হেনরি মোর্স উদ্ভাবন করে ফেলেন টেলিগ্রাফের। টরে-টক্কা দিয়ে আপনি যদি বার্তা পাঠাতে পারেন, তাহলে দ্রুতই সেটি পৌঁছে যাবে অপর প্রান্তে। এ খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি হন মধ্য এশিয়ার কিংবদন্তির চরিত্র নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। হোজ্জার দৈনন্দিন কাজের একটা ছিল অন্যদের চিঠি লেখে দেওয়া। কথিত আছে, একবার এক লোক হোজ্জাকে তার বোনের কাছে চিঠি লিখে দিতে অনুরোধ করলে হোজ্জা তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তার ‘পায়ে ব্যথা’। হতভম্ব ওই লোকের দিকে তাকিয়ে হোজ্জা জানান, তার হাতের লেখা একমাত্র সে নিজেই পড়তে পারে! পায়ের ব্যথার জন্য অত দূর যাওয়া সম্ভব নয়।
টেলিগ্রাফের আবির্ভাব ও খরচের কারণে ডাকের ব্যবহার আরও কমে যেতে পারে এ আশঙ্কা সত্যি হওয়ার আগেই স্যার রোনাল্ড হিল ১৮৩৭ সালে এক আশ্চর্য পদ্ধতি বের করে ফেলেন—আঠাযুক্ত টিকিট। তাঁর এই বুদ্ধি নিয়ে ১৮৪০ সালের ৬ মে চালু হয় বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট—পেনি ব্ল্যাক। ছোট্ট এক টুকরা আঠাযুক্ত কাগজের ওপর রানি ভিক্টোরিয়ার ‘ফেসবুক প্রোফাইল’।
এসব যখন হচ্ছে, তত দিনে কিন্তু বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলোতে ডাকব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যেমন ওয়ারেন হেস্টিং ভারতের মুম্বাই, চেন্নাই আর কলকাতায় ১৮৭৪ সালেই এটা চালু করে দেন। কাছাকাছি সময়ে ডাকব্যবস্থা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও।
১৮৪০-এর দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক ব্যবসায়িক মডেলের আবির্ভাব ঘটে। উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্যের একটা ক্যাটালগ ডাকযোগে, সাশ্রয়ী মূল্যে বাসাবাড়িতে পাঠানো শুরু করেন। সঙ্গে একটা অর্ডার ফরম। ইচ্ছা হলেই অর্ডার করে ফেলতে পারেন (১৯৯৯ সালেও যুক্তরাষ্ট্রে ডাকযোগে জুতা বিক্রির পরিমাণ ছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল নামের এক উদ্ভাবক বিজ্ঞানী টেলিফোন আবিষ্কার করেন! উদ্যোক্তারা ডাকযোগে মেইল অর্ডার পাঠাতে যাঁদের অনীহা, তাঁদের টেলিফোন করতে উৎসাহিত করতেন। চালু হয়ে গেল কলসেন্টার সেবা!
মালামাল, চিঠি, পণ্য—সবই তো হলো। বাকি থাকল কী? টাকা!
যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ লক্ষ করল, ইউনিয়নের সৈনিকেরা তাঁদের বেতনের টাকা খামে ভরে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। ডাক বিভাগ ভয় পেল দুই কারণে—এক খামের ভেতরে টাকার নিরাপত্তা কে দেবে কিংবা টাকা বহনকারীর নিরাপত্তা? মনে আছে, দীনু ডাক হরকরার টাকার ব্যাগ ছিনতাই করতে চেয়েছে তাঁরই পুত্র!
সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ১৮৭২ সালে। মানি অর্ডার—পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানো। ১৮৯০ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ১১০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তরিত হয়েছে এ পদ্ধতিতে। ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর যশোরের পাইকগাছায় প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। সেই বছরেই ব্রিটিশ ভারতে চালু হয় ডাক বিভাগের ব্যাংকিং সেবা। ১৮৬১-এর এই ডাক-ব্যাংকিং সিস্টেমের প্রভাবে কি না, কে জানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে নিজেই কৃষকদের জন্য একটি ব্যাংক চালু করেছিলেন!
টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, মালামাল আর চিঠিপত্র নিয়ে বিশ্বজুড়ে ডাক বিভাগ ভালোই ছিল। কিন্তু বাদ সেধেছে ইন্টারনেট। ই-মেইলের পাল্লায় পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে হাতে লেখা চিঠি আর মেইল অর্ডার। সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে এসে জুটেছে স্মার্টফোন। ২০০৬–২০০৭ সালে রংপুরের এক দিনমজুর বগুড়ায় কাজ করতে এসে মুঠোফোনের টকটাইমকে টাকায় কনভার্ট করার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর করা বন্ধুর মোবাইল রিচার্জের টাকা বন্ধু ওই উদ্ভাবনী দিনমজুরের স্ত্রীকে পৌঁছে দেন! ঠিক একই সময়ে আফ্রিকার কেনিয়ায় চালু হয় মুঠোফোনে আর্থিক সেবা এম-পেসো। ২০১১ সালে সেটি এসে পড়ে বাংলাদেশে। মানি অর্ডারের চক্কর থেকে মানুষ চলে যায় ‘বিকাশ করো’র যুগে।
এমন কঠিন সময়ে ডাক বিভাগ কেমন করে টিকে থাকবে? তাকেও হতে হবে ইনোভেটিভ, উদ্ভাবনী।
এই যেমন সারা দেশের ডাকঘরগুলো হয়ে উঠতে পারে ডিজিটাল সেবার কেন্দ্র, ডাকটিকিটের মতো উদ্ভব হতে পারে প্রি-পেইড সিস্টেম, যা হয়ে উঠবে ই-কমার্সের বন্ধু কিংবা ডাকঘরই হবে নতুন ডিজিটাল পোস্ট ব্যাংকিং সিস্টেমের আধার।
লেখক: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান