শিশু-কিশোরদের গণ্ডি ছোট থাকে। চোখের সামনে তারা যা দেখে অনায়াসে তা আয়ত্ত করে ফেলে। তারা যাকে পছন্দ করে, তার আচার-আচরণ অনুসরণ ও অনুকরণ দুটোই করে। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে জড়িয়েই বড় হচ্ছে শিশু-কিশোররা। তারা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে পটু, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের দৃষ্টি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এমন একটি স্পর্শকাতর সময়েই হাতের তালুতে মেহেদি দিয়ে আঁকা ‘মিডল ফিঙ্গার’ প্রদর্শন করে ভয়াবহ অশ্লীলতার ইঙ্গিত দিলেন নায়িকা পরীমণি। যা নিয়ে নানান মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
শিশু-কিশোররা বয়জ্যেষ্ঠ কাউকে কিছু করতে দেখে সেটি শিখে তা নিজেও প্রদর্শন করলে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন দেশের সচেতন নাগরিক ও অভিভাবকরা। তাছাড়া পরীমণি একজন নায়িকা হিসেবে, তিনি ‘পাবলিক ফিগারও’ বটে! তার এমন আচরণের প্রভাবে শিশু-কিশোররা অসময়ে যৌন আচরণ প্রদর্শন করার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যা আমাদের আন্ত:সামাজিক ও কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে কোনভাবেই যায় না।
বিজ্ঞজনরা বলছেন, দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন শিল্পীর এমন আচরণে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলতে পারে শিশু-কিশোররা।
তাই সেলিব্রেটি হিসেবে পরীমণিকে সতর্ক করে দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শন করতে মতামত দিয়েছেন বিজ্ঞজনরা।
পরীমণির ভেরিফায়েড পেজে সেই ‘সিম্বল’ প্রদর্শন
এদিকে পরীমণি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ‘Pori Moni’ তে আজ বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১ টা ২১ মিনিটে এটি ছবি আপলোড দেন। যেটিতেও সেই অশ্লীল সিম্বল অঙ্কিত হাতের তালু প্রদর্শন করা অবস্থায় দেখা গেছে। আপলোড করা ওই পোস্টে রাত ৯ টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৮০ হাজারেরও বেশি নেটিজেনকে রিএ্যাক্ট দিতে দেখা গেছে। এছাড়াও পোস্টটি শেয়ার করেছেন ১ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ।
‘…ক মি মোর’ বিষয়ে গণমাধ্যমকে যা বলেছেন পরীমণি
এবারের বার্তাটি প্রসঙ্গে আজ বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) পরীমণির সঙ্গে কথা হয় দেশের প্রথম সারির একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের। ওই পোর্টালটির প্রতিবেদককে দেয়া সাক্ষাৎকারে পরীমণি বলেছেন, “আমার কষ্ট লাগছে এখন। অনেকেই আমার বার্তাটি ঠিক বুঝতে পারছেন না, ভুল বুঝছেন। সবাই ভাবছেন আমি লিখেছি ‘লাভ মি মোর’। আসলে তো আমি লিখেছি ‘…ক (গালি) মি মোর’।’’
কিন্তু কেন এই বার্তা? এখন তো সবই আপনার অনুকূলে। কার উদ্দেশে এটি বলেছেন? জবাবে পরীমণি বলেন, ‘যারা আমার জীবন নিয়ে খেলতে চায় বা ঘাটতে আসে, তাদের সবাইকে আমি ওয়েলকাম করছি। আসো। ওয়েলকাম। আমি প্রস্তুত তোমাদের সঙ্গে এই খেলায় অংশ নিতে। দম যতদিন আছে, আমি শেষ অবধি এই খেলায় লড়ে যাবো।’
ছেলের প্রশ্নে আটকে যাওয়া সচেতন অভিভাবকের মন্তব্য
একজন সচেতন অভিভাবক নাহিয়ান আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘আজ পরীমণির হাতের তালুর লেখা দেখে আমি ও আমার স্ত্রী বিস্মিত হয়ে হাসছিলাম। এরমধ্যেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হলো আমাদেরকে। একমাত্র সন্তান শিশু মেয়েটা পরীমণির হাতে লেখা দেখে প্রশ্ন করে বসলো- ‘আব্বু, ইংরেজিতে ‘ME MORE’ লেখা বুঝেছি, কিন্তু তার উপরে মধ্য আঙুল এঁকে কি বোঝালো বুঝলাম না?’
নাহিয়ান বললেন- ‘বাচ্চার এমন প্রশ্নে কি উত্তর দিবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না! আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলাম। ভাবছিলাম- কোথায় যাচ্ছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা? দেশ থেকে আইন-বিচার কি হারিয়ে গেলো? যে যা ইচ্ছা তা’ই করছে! যা পাবলিকলি দেখাতে মন চাচ্ছে তা’ই দেখাচ্ছে! নেই কোনো প্রতিবাদ-প্রতিকার! এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই?’
বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিউজ প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেন এই অভিভাবক।
পর্নোগ্রাফির যে ধারায় অপরাধ ও শাস্তি
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরটিভি নিউজ কথা বলে আন্তর্জাতিক বার অ্যাসোসিয়েশন প্রদত্ত “আইবিএ প্রোবোনো অ্যাওয়ার্ড, ২০২০” অর্জনকারী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসানের সঙ্গে।
এই আইনজীবী বলেন, “পর্নোগ্রাফি আইন-২০১২ সালের ২ এর ‘গ’ উপধারায় ‘পর্নোগ্রাফি’ এর সজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরণের অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে একই আইনের ৮ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে- ‘কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে গণউপদ্রব সৃষ্টি করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। পর্নোগ্রাফি আইনের অপরাধসমূহ আমলযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য অর্থাৎ জামিনযোগ্য নয়।’
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘এখানে নায়িকা পরীমণি পর্নোগ্রাফি আইনের ‘গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই’ সজ্ঞামতে অপরাধ করেছেন বলে মনে করছি। তবে কেউ এ বিষয়ে থানায় কিংবা আদালতে অভিযোগ না করলে আইনের প্রয়োগ বিচার পর্যন্ত গড়াবে কেমন করে?
যা বললেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ
বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশি, আমাদের সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল কালচার আছে। বিপরীতে এই দেশে কিছু লোকজন এবং কিছু নায়ক নায়িকারা আছে, যারা আমাদের সুন্দর কালচারকে টোটাললি অবজ্ঞা করে চলছে। তারা আমাদের সমজাটাকে এমনভাবে দূষিত করছে, যে আমরা বাঙালি সমাজ, আমাদের সুন্দর ঐতিহ্য আছে, সেই জিনিসগুলো ভবিষ্যতে না রাখার জন্য তৎপরতা শুরু হয়েছে।’
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- ‘যে দেশে প্রকোশ্যে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে, এবং সেই নারীর সম্পর্কে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয় না। এর কারণ হলো- ওই নারী যে কোনো সময় যে কারও বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি (পরীমণি) যে ‘সাইনটা’ দেখিয়েছেন, সেটি অত্যন্ত অসন্মানজনক। কারণ একেকটি ফিঙ্গার দেখিয়ে, একেকটি মিনিং বোঝানো হয়। এরমধ্যে ‘মধ্যমা আঙ্গুল’ অশ্লীল ইঙ্গিত দিতে ব্যবহার করা হয়। এটি বিদেশে বহুল ব্যবহৃত। অশ্লীলতা প্রকাশে এটির প্রদর্শন কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরীমণি যে সিম্বলটি দেখিয়েছেন, সেটি দেখানোয় যদি কোনো ব্যক্তি অপমানিত বোধ করেন, তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দায়ের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
‘কিন্তু কথা হচ্ছে- এই সিম্বলটি কার উদ্দেশ্যে তিনি দেখিয়েছেন সেটি স্পষ্ট নয়। যেহেতু পাবলিকলি দেখানো হয়েছে, তাই সরকার (প্রশাসন) চাইলেও বাদি হয়ে অশ্লীলতা প্রদর্শনকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।’
আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু যা বললেন
বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘মিডল ফিঙ্গার’ এঁকে সেটি প্রদর্শন করা নিশ্চিত সামাজিকভাবে ঘৃণা ও অপরাধমূলক কাণ্ড। এমন আচরণে কেউ যদি ক্ষুব্ধ হয় এবং এটিকে ‘বেড ম্যাসেজ’ মনে করে। তাহলে ওই ক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে প্রদর্শনকারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও কোন অভিভাবক যদি আদালতকে বলেন যে- এর দ্বারা আমার শিশু বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু পরীমণি একজন জনপ্রিয় নায়িকা, তিনি অশ্লীলতা প্রদর্শন করেছেন। তার বিরুদ্ধ আইনি পদক্ষেপের আবেদন জানাচ্ছি।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতামত
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বিশেষত শিশুদের মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করেন। পরীমণির হাতে অঙ্কিত ‘মিডল ফিঙ্গার’ প্রদর্শনে শিশুদের মনে কেমন প্রতিক্রিয়া পড়ার আশঙ্কা রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আরটিভি নিউজের কাছে মতামত প্রকাশ করেছেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘পরীমণি এখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন। যা এখনও চলমান রয়েছে। একজন সেলিব্রেটি হিসেবে তিনি আজ যা প্রদর্শন করেছেন তা ঠিক হয়নি। কেননা এটি পাবলিকলি তিনি প্রদর্শন করেছেন। যা অনেক বাচ্চারাও দেখেছে। নিশ্চয়ই তাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, হাতের তালুতে লেখার সঙ্গে কি সিম্বল দেখালেন পরীমণি? যে প্রশ্নর উত্তর নিশ্চয়ই বিব্রতকর এবং কোন অভিভাবক এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। পরীমণিকে এটি মাথায় রাখা উচিৎ ছিলো যে- তিনি একজন পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রেটি। ওনার চালচলন, কথাবার্তা বা আচার আচরণ শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক অনেকেই ফলো করছে। তাই কেবল পরীমণি নয়, সেলিব্রেটি সকলকেই আরও দায়িত্বশীল আচরণের মধ্যে থাকতে হবে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মিজান মালিক যা বললেন
দীর্ঘদিন আইন ও অপরাধ বিটে দায়িত্ব পালন করছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মিজান মালিক। যিনি এখন দৈনিক আমাদের সময়ে উপ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইসাথে তিনি বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) এর সভাপতি হিসেবেও রয়েছেন।
আরটিভি নিউজ কথা বলে সাংবাদিক মিজান মালিকের সঙ্গে। পরীমণির হাতে প্রদর্শন করা সিম্বলের বিষয়ে মন্তব্য করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘পরীমণি হাতে যা লিখেছেন বা এঁকেছেন, এটি সত্যিই একটা বিব্রতকর বিষয়। কোনো শিশু বা তরুণী বয়সী কেউ যদি তার অভিভাবককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে সেটির উত্তর কি হবে তা আমারও জানা নেই! পরীমণি যেহেতু পাবলিক ফিগার, সেহেতু ওনাকে অবশ্যই সকল বয়সীদের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ করে ওনার ভক্ত-দর্শকদের বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
পরীমণি যদি কোন বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে চান, তার শালীনতার মধ্যে থাকা জরুরী। প্রতিবাদে ভাষা বা সিম্বল ব্যবহারেরও একটা সীমারেখা থাকা উচিৎ। তাই এই বিষয়ে পরীমণিকে আরও সচেতন ও সতর্ক হওয়া জরুরী।
আরটিভি নিউজ থেকে সংগৃহিত