গালফবাংলাটাইমস বিনোদন : অভিনেত্রী আশা চৌধুরীই ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সংসারের খরচ, তিন বোনের লেখাপড়া চালাতেন তিনি। আর ছিলেন মা–বাবার বেঁচে থাকার অবলম্বন। মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আশার মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে তাঁর পরিবার।
‘মেয়েই আমার সংসারটা চালাত। মুহূর্তেই সংসারটা কানা করে দিয়ে গেল ঘাতক ট্রাক। আমি এখন কীভাবে সংসার চালাব, কোনো কূলকিনারা দেখতে পারছি না।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন আশার মা পারভিন আক্তার। মিনিট খানেক কান্নার পর বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার আশা কই গেল। কই গেলি মা আশা।’ পাশ থেকে সমস্বরে দুই-তিনজনের কান্নার শব্দ শোনা যায়। ধারণা করা যায়, তাঁরা আশার ছোট তিন বোন মিম, তিশা ও তিথি। বড় বোনকে হারিয়েছে, পড়াশোনা কীভাবে শেষ করবে তারা, নিজেরাও জানে না।
তিন বোনকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখতেন বড় বোন আশা। যেখানেই থাকুক, প্রতিদিন তিন থেকে চারবার ফোনে ছোট বোনদের খবর নিতেন তিনি। চার বোন একত্রে আড্ডা দিতেন, খেতেন, ঘুরতে যেতেন। বড় বোন শুটিংয়ের কাজে বাইরে থাকলে অন্যরা জেগে তাঁর জন্য অপেক্ষা করত।
এসব বলতে বলতে কান্না থামিয়ে আশার মা বলেন, ‘আশার বাবার চাঁদনিচকে কাপড়ের দোকান ছিল। করোনা মহামারির মন্দাবাজারে সেটা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এখন সে ঘরে বসা। কোনো কাজ নেই। আমার মেয়ে বলত, “আব্বা তোমাকে কিছু করতে হবে না। সব আমার ওপর ছেড়ে দাও।” মেয়েটা আমার চাকরি করত, পড়াশোনা করত, আবার অভিনয়ে সময় দিত। কোনো বাজে আড্ডার সঙ্গে ছিল না, এতটুকু সময় নষ্ট করত না।’
বনানীতে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন আশা। পাশাপাশি আইন বিষয়ে পড়তেন। স্বপ্ন ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হবেন। সেই স্বপ্ন ৫ সেকেন্ডেই শেষ হয়ে যায়। ৩ জানুয়ারি ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর সঙ্গে মরে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। পারভিন আক্তার বলেন, ‘আশা বলত নাটক, সিনেমায় অনেক কিছু শেখানোর জিনিস থাকে। আমি সেসব নাটকে অভিনয় করব। একদিন দেখবা পরিশ্রমে অনেক ওপরে উঠব। আমাদের সবকিছু হবে। সেই মেয়েটা প্রথমবারের মতো ভালো অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার দুই দিন পরে চিরতরে চলে গেল।’
২ জানুয়ারি আশা চৌধুরী অভিনয় করেন ‘দ্য রিভেঞ্জ’ নাটকে। এই নাটকেই প্রথমবারের মতো প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আশা। তাঁর সহশিল্পী ছিলেন সালাহউদ্দিল লাভলু ও আনিসুর রহমান মিলন। নাটকটির পরিচালক ছিলেন রুমান রুনি।
ছোট তিন বোন ছিল আশার ভীষণ আদরের। তাদের পড়াশোনাসহ সব খরচ দিতেন আশাই। আশার ছোট সুমাইয়া আক্তার মিম মিরপুর রূপনগর মডেল কলেজে পড়াশোনা করে। আশার সবচেয়ে আদরের ছিল সে। পরিবারের টানাপোড়েনের কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে মিম। আশা তাকে সব সময় বলত, যেন চিন্তা না করে। সাহস দিত, ভবিষ্যতে তাকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। সব সময় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে বলতেন। সেই বোনকে হারিয়ে এখনো কান্না থামছে না মিমের। বোনের মরদেহ বাড়িতে যাওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছিল মিম। বোনের শোকে কাঁদতে কাঁদতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাকে মিরপুরের একটি হাসপাতালে নিতে হয়। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে মিম জানায়, বড় বোনের সঙ্গে সে ঘুমাত। পরীক্ষা বা শুটিংয়ের সময় সে নিজে বোনের ব্যাগ গুছিয়ে দিত। মিম বলে, ‘আপা আমাকে মন দিয়ে পড়তে বলত। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করত। সেই বোনকে শেষবারের মতো দেখতেও পারলাম না’।
বিনোদন অঙ্গনে কাজ করতে ভালোবাসতেন আশা। সে জন্য পরিবার থেকে কোনো বাধা ছিল না। শৈশবে শিশুশিল্পী হিসেবে বিটিভিতে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। প্রায় চার বছর আগে মূলধারার নাটকে কাজ শুরু করেন। নাটকে অভিনয়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ছাড়াও তিনি বিজ্ঞাপন ও গানের মডেল হয়েছেন তিনি।
আশা খুবই পরিশ্রমী ও কর্মঠ ছিলেন। সে কারণে পরিবারের সবাই তাঁর সিদ্ধান্তকেই গুরুত্ব দিতেন। আশার সেজ বোন তাইয়েরা জান্নাত তিশা জানায়, তার বোন খেতে খুব পছন্দ করতেন। একটু মোটা বলে শুটিংয়ে অনেকেই তাঁকে ‘মোটা’ বলত। এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরে আশা বাসায় খুব একটা খেতেন না। অভিনয়শিল্পী হওয়ার জন্য শরীরের প্রতি খুব যত্ন নিতেন তিনি। তিশা বলে, ‘অনেকেই বলত আপা দেখতে সুন্দর না। আপা বলতেন, “দেখিস একদিন আমার চেহারা আরও সুন্দর হয়ে যাবে। তখন আরও কাজ বাড়বে।” আপা বলতেন, আর পাঁচ–ছয় বছর আমাদের কষ্ট করতে হবে। এরপর আমাদের আর কষ্ট থাকবে না।’
অনেক দিন ধরে ধারদেনা করে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে ছোট একটি বাড়ি বানাচ্ছিলেন আশার বাবা আবু কালাম। সেই বাড়ির কাজ এখনো বাকি। ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে বাড়ি বানাতে সহযোগিতা করছিলেন আশা। আবু কালাম জানান, করোনা তাঁর ব্যবসা কেড়ে নিল, ট্রাক কেড়ে নিল মেয়েকে। তিনি বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে কীভাবে চলব, সেটাই বড় চিন্তা। আমি চাই সেই একজন (শামীম আহমেদ) তো থানায় আছে। পুলিশ এখন ট্রাকচালককে ধরার চেষ্টা করুক।’