শুধু সড়কই না, গ্রামে স্কুলও করা হয়েছে প্রবাসীদের টাকায়। কারোর পড়ার খরচ লাগবে, চিকিৎসার টাকা চাই, সমাধান প্রবাসীদের ট্রাস্ট।
রাস্তাটা ছিল এবড়োখেবড়ো, মাটির। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদাপানিতে থিকথিক করত। পিচ্ছিল পথ ধরে হাঁটাই মুশকিল হয়ে পড়ত। বর্ষা হলে ডুবে যেত রাস্তাটি। চলাচলে ভরসা ছিল নৌকা। শুকনো মৌসুমে ভাঙাচোরা সেই সড়কে কোনো যানবাহন চলত না।
গ্রামীণ সেই কাঁচা সড়ক এখন পাকা হয়েছে। সড়কের দুই পাশও হয়েছে সবুজময়। রাস্তা ধরে দিনরাত ছুটে চলে যানবাহন। চার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি পাকা করতে ব্যয় হয়েছে কোটি টাকা। এর পুরোটাই এসেছে প্রবাসীদের তহবিল থেকে। শুধু এই সড়কই না, গ্রামে একটি স্কুলও করা হয়েছে প্রবাসীদের টাকায়। এমনি উদাহরণ আরও আছে। কারোর পড়ার খরচ লাগবে, চিকিৎসার টাকা চাই, মেয়েকে বিয়ে দেবেন টাকা নেই, সমাধানে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসীরা। তাঁদের গড়া ট্রাস্ট থেকে ব্যয় করা হয় মানুষের কল্যাণে। যার আলোয় আজ আলোকিত সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাটিজুরা নামের একটি গ্রাম।
২০০১ সালে ‘মাটিজুরা এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট, ইউকে’ নামের একটি ট্রাস্ট গড়ে তোলেন গ্রামের ১৫০ জন ব্রিটেনপ্রবাসী। লন্ডনে বসে ট্রাস্ট চালান তাঁরা। আর উন্নয়ন হয় সিলেটের পাড়াগাঁয়ে।
ট্রাস্ট যেভাবে চলে
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিলপাড়া ইউনিয়নের মাটিজুরা গ্রামে ৪৮৫টি পরিবার এবং ১২ হাজার বাসিন্দার বাস। গ্রামে আছে ২০ শতাংশ দরিদ্র পরিবার। যেকোনো আর্থিক সংকট-সমস্যায় অসহায়দের ভরসা হয়ে পাশে থাকে ট্রাস্ট।
ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এহিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছিলেন। লন্ডনে যাওয়ার আগে গত মার্চে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, লন্ডনে ট্রাস্টের সদস্যরা তো যুক্ত আছেনই। পাশাপাশি গ্রামের আটজনকে সমন্বয়ক হিসেবে রাখা হয়েছে। মূলত গ্রামে থাকা সমন্বয়কদের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও উদ্যোগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতি মাসে ট্রাস্ট গ্রামে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে।
সবার পাশেই প্রবাসীরা
টাকার অভাবে চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার করতে পারছেন না—এমন কেউ ট্রাস্টে আবেদন করলে তাঁকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত এমন অনুদান পেয়েছেন ২০ জন। আবার কেউ বিয়ে করার জন্য আর্থিক সহায়তা চাইলে তাঁকে দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত গ্রামের ৩৫ জন এমন সহায়তা পেয়েছেন। প্রতি মাসে গ্রামের ২৩ জনকে ৩০০ টাকা করে বিধবা ভাতা দেওয়া হয়। এতিম-দরিদ্র তহবিল থেকেও অনেকে সহায়তা পান।
২০০৫ সালে তিলপাড়া-মাটিজুরা যে সড়কটি প্রবাসীরা নির্মাণ করেছেন, প্রতিবছর এর সংস্কার বাবদ গড়ে ২০ হাজার টাকা ট্রাস্ট দেয়। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্যোগে ত্রাণসহায়তা ও ঈদে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ সেসবও চলে ট্রাস্টের টাকায়।
ধনী-গরিবনির্বিশেষে পুরো গ্রামের মানুষ একসূত্রে গাঁথা। কেউ সমস্যায় পড়লেই ট্রাস্ট থেকে অনুদান পাচ্ছেন, এমন আদর্শ গ্রামের উদাহরণ খুব কমই আছে।
ট্রাস্ট-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রামের জামেয়া আশরাফিয়া ইসলামনগর মাটিজুরা মাদ্রাসার তহবিলে ছয় বছর ধরে মাসিক আর্থিক সহায়তা করে আসছে ট্রাস্ট। মাদ্রাসার নামে ৪৪ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা মাদ্রাসা পেয়ে থাকে।
মাটিজুরা সুনামপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী নোমান আহমদ (৩৫) জানান, গ্রামের মাটি ও মানুষের প্রতি প্রবাসীদের টান দেখে গ্রামবাসীও মুগ্ধ।
আলোর বাতিঘর
গ্রামের আশপাশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় ট্রাস্ট ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করে মাটিজুরা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। তবে এরই মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির কার্যক্রম চালু করার জন্য আবেদন করা হয়েছে।
গ্রামবাসী জানিয়েছেন, গ্রামের ৩৫ জন ব্যক্তি প্রায় ৫২ শতক জমি বিদ্যালয়ের নামে দান করেছেন। প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়ের আধপাকা টিনশেড ভবন তৈরি করেছে ট্রাস্ট। বর্তমানে ১০৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এখানে। শিক্ষক আছেন পাঁচজন। বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে ভর্তি বা মাসিক কোনো ফি দিতে হয় না।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. বিলাল উদ্দিন জানান, বিদ্যালয় পরিচালনা বাবদ প্রতি মাসে এক থেকে সোয়া লাখ টাকা ট্রাস্ট দিয়ে থাকে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুকিত বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য শিগগির নিজস্ব পরিবহন সুবিধা চালু হবে। যেহেতু বিদ্যালয়ে পড়তে শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হয় না, তাই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনাও নেই।
বিশিষ্টজনেরা যা বলেন
তিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, মাটিজুরা গ্রামের লন্ডনপ্রবাসীরা একত্র হয়ে গ্রামের উন্নয়নে কাজ করছেন। তাঁদের সহায়তার কারণে গ্রামের অনেক অসচ্ছল মানুষ সচ্ছল হয়েছে। ধনী-গরিবনির্বিশেষে পুরো গ্রামের মানুষ একসূত্রে গাঁথা। কেউ সমস্যায় পড়লেই ট্রাস্ট থেকে অনুদান পাচ্ছেন, এমন আদর্শ গ্রামের উদাহরণ খুব কমই আছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, ‘উপজেলায় প্রায় প্রতিটি গ্রামের উন্নয়নেই প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রবাসীদের এই দরদকে সম্মান জানাই। মাটিজুরা গ্রামের উন্নয়নেও প্রবাসীদের অনন্য ভূমিকা আছে। তাঁদের কর্মকাণ্ড অনুসরণযোগ্য।’
সুত্র:প্রথম আলো